রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
رياض الصالحين من كلام سيد المرسلين
ইসলামী শরীআহর মূল উৎস হলো, আল্লাহপাকের কালাম "আলকুরআনুল কারীম" এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের "হাদীস ও সুন্নাহ্”। কুরআনুল কারীমের বহু আয়াতের তাফসীর (ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ) হাদীস ও সুন্নাহয় বিবৃত হয়েছে। এ কারণেই ওহীর প্রায় সূচনাকাল হতেই যুগসচেতন উলামায়ে কেরাম একদিকে যেমন কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। রচনা করেছেন তাফসীর সংক্রান্ত বহু কিতাব। তেমনি অপর দিকে মুহাদ্দিসীনে 'ইযাম সংকলন করেছেন বহু ধরনের হাদীস গ্রন্থ। এক্ষেত্রে মৌলিক কিতাব যেমন সংকলিত হয়েছে। তেমনি হাদীস ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণমূলকও অনেক কিতাব রচিত হয়েছে।
এ উভয় প্রকার কিতাব যদিও বিভিন্ন আঙ্গিকে ও বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা হয়েছে, কিন্তু পাঠক-পাঠিকাদের স্তরবিবেচনায় তা দু'ভাগে বিভক্ত। এক প্রকার হলো, যা কেবল শাস্ত্রজ্ঞ উলামায়ে কেরামের উদ্দেশ্যেই রচিত হয়েছে। এ প্রকারের কিতাব অধ্যয়ন করে তা থেকে উপকার লাভ একান্তই শাস্ত্রীয় পরিভাষা, ফন্নী মাহারাত ও গভীর ইলমী যোগ্যতার উপর নির্ভরশীল। কেবল ভাষাজ্ঞান থাকাই যথেষ্ট নয়। বরং সাধারণ পাঠকের ক্ষেত্রে এ জাতীয় কিতাব পাঠ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এর দ্বারা তাদের ভুল অর্থ বোঝা এবং পরিণামে ঈমান ও আমলের দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকাই প্রবল।
আরেক প্রকার কিতাব যা সাধারণ মুসলমানের জ্ঞানচাহিদা নিবারণ ও ইলম হাসিলের নিমিত্তে রচিত হয়েছে। যা থেকে সবশ্রেণীর পাঠকই উপকৃত হতে পারেন। কিন্তু শত আফসোস ও অনুতাপের বিষয় যে, প্রচারমাধ্যম ও মুদ্রণসামগ্রীর প্রাবল্য ও সহজলভ্যতার এ যুগে কিছু অসচেতন পুস্তকব্যবসায়ী বাছ-বিচার ছাড়াই সব ধরনের কিতাব সকল শ্রেণীর পাঠককে ধরিয়ে দিচ্ছেন এবং এক শ্রেণীর পাঠকও অতি আগ্রহে নিজেদের জন্য প্রযোজ্য নয় এমন কিতাবই পাঠ করতে অগ্রসর হচ্ছেন। ফলাফল যেমন ভয়াবহ হওয়ার তেমনই হচ্ছে। অথচ এ সকল সাধারণ মুসলমানগণের প্রয়োজনীয় দীনী ইলম হাসিলের জন্য, তাদের উপযোগী করে প্রায় প্রতি যুগের উলামায়ে কেরামই তাফসীর ও হাদীসসহ বিভিন্ন বিষয়ে সুন্দর সুন্দর দীনীগ্রন্থ রচনা ও সংকলন করেছেন। সাধারণের উচিত এ সকল কিতাব অধ্যয়ন করে দীনী ইলম হাসিল করা। তবে এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টির প্রতি খুব বেশি লক্ষ রাখা উচিত, তা হলো নিজে নিজে কোনো কিতাব চয়ন না করা বরং নিজের দীনী মুরুব্বী ও হক্কানী অভিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের পরামর্শ নেওয়া। সাথে সাথে আরেকটি বিষয়ও মনে রাখতে হবে যে, কিতাব-পত্র ও অন্যান্য জ্ঞান অর্জনের উপকরণ আমার শিক্ষক নয়; এগুলো মাধ্যমমাত্র। উস্তায ও শিক্ষক তো কোনো অভিজ্ঞ আলেমই হতে পারেন। আর শিক্ষক কিংবা উস্তায ব্যতীত একা একা যে জ্ঞান অর্জন করা হয় সেটা অনেক সময়ই ক্ষতির কারণ হয়। তাই এ ব্যাপারে খুব বেশি সচেতনতার প্রয়োজন।
রিয়াযুস সালিহীন হাদীস বিষয়ক কিতাব, যা উপরোক্ত উভয় স্তরের পাঠকের দীনী ইলমের চাহিদা পূরণ করে থাকে। বিশেষত দ্বিতীয় স্তরের পাঠক, তথা সাধারণ মুসলমানের দীনী ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে এ গ্রন্থ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে আসছে। আল্লামা নববী রহ. যখন এ কিতাব সংকলন করেছেন প্রায় সে সময় থেকেই এ কিতাব সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
এ কিতাব আরব-অনারব নির্বিশেষে মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশে দীনী শিক্ষালয়ের মাধ্যমিক শ্রেণীর পাঠ্য তালিকাভুক্ত। তাছাড়া ঘরে, মজলিসে ও মসজিদে দীনী তা'লীমের হালকায় এ কিতাবের সম্মিলিত পাঠ পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই জারি আছে। একজন মুসলিমের প্রয়োজনীয় ঈমান-আকীদা, আমল-আখলাক তথা সার্বিক দীনী বিষয়ের একটি পূর্ণচিত্র এর দ্বারা লাভ করা যায়।
অনেকের মতে সমগ্র বিশ্বে হাদীস বিষয়ক কিতাবসমূহের মধ্যে সর্বাধিক সমাদৃত ও পঠিত অনন্য হাদীস সংকলন এই "রিয়াযুস সালিহীন" নামক কিতাব।
ইমাম নববী রহ.-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
ইমাম নববী রহ.-এর মূল নাম ইয়াহইয়া ইবনে শারাফ। উপনাম আবূ যাকারিয়া। সিরিয়ার অন্তর্গত হাওরান এলাকার 'নাওয়া' নামক স্থানের অধিবাসী ছিলেন। সেই হিসেবে তাকে নাওয়াবী (নববী) বলা হয়।
হিজরী ৬৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই শান্ত প্রকৃতির ছিলেন। খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ ছিল না। সমবয়সী শিশুরা খেলাধুলার জন্য তাকে ডাকাডাকি করত, কিন্তু তিনি এড়িয়ে যেতেন। বেশি জবরদস্তি করলে কেঁদে দিতেন এবং পালিয়ে বাঁচতেন। মূলত তাঁর আকর্ষণ ছিল কুরআন শিক্ষার প্রতি।
দশ বছর বয়সকালে তার পিতা তাকে দোকানে বসিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বেচাকেনার প্রতি বিশেষ লক্ষ ছিল না। সর্বক্ষণ কুরআন তিলাওয়াত করতেন। এ সময় তার প্রতি শায়খ ইয়াসীন মাররাকুশী রহ.-এর নজর পড়ে। তিনি তার ভেতর আগামী দিনের বিপুল সম্ভাবনার আভাস দেখতে পান। তখনই তিনি তার শিক্ষকের সংগে সাক্ষাত করেন এবং তার তা'লীম-তরবিয়াতের প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়ার অসিয়ত করেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন- আশা করা যায় এ শিশু তার কালের শ্রেষ্ঠ 'আলেম ও শ্রেষ্ঠ যাহিদ হবে। লোকে তার দ্বারা অনেক উপকার পাবে। শিক্ষক তাকে বলেছিলেন, আপনি গণক নাকি? তিনি বলেছিলেন, গণক নই তবে এ কথা আল্লাহ তা'আলাই আমাকে দিয়ে বলিয়েছেন। শিক্ষক শায়খ মাররাকুশীর এ কথা তার পিতাকে অবহিত করলেন এবং তাকে 'ইলমে দীনের শিক্ষায় নিয়োজিত করতে উৎসাহ দিলেন। সুতরাং তার পিতা তার শিক্ষার প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান হলেন।
শৈশব অবস্থায়ই তিনি পূর্ণ কুরআন মাজীদের হাফেজ হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে তার পিতা তাকে দিমাশকে নিয়ে যান। এটা হিজরী ৬৪৯ সালের কথা। তখন তার বয়স হয়েছিল ১৯ বছর। দিমাশক তখন 'উলামা ও ফুযালার কেন্দ্রভূমি। সেখানে তিন শতাধিক দীনী শিক্ষালয়। দুনিয়ার চারদিক থেকে 'ইলমে দীনের সন্ধানীরা সেখানে অদম্য আগ্রহ নিয়ে ছুটে আসে। কুরআন-সুন্নাহসহ 'ইলমে দীনের আরও বিভিন্ন শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে আপন আপন দেশে ফিরে যায়। ইয়াহইয়া নববীও একইরকম পিপাসা নিয়ে দিমাশকে উপস্থিত। তিনি পর্যায়ক্রমে এখানকার বড় বড় ফুকাহা ও মুহাদ্দিছীনের দরগাহে উপস্থিত হতে থাকেন এবং তাদের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে আপন জ্ঞানপিপাসা নিবারণে ব্রতী হন।
'ইলমে দীনের প্রতি তার গভীর আগ্রহ তার উস্তাযদের নজর কাড়ে। তারাও বিশেষ যত্নের সাথে তাকে শিক্ষাদান করতে থাকেন। তার স্মরণশক্তি ছিল প্রখর।
কোনও বিষয় একবার পড়লে সহজে ভুলতেন না। উস্তাযদের কাছে তিনি প্রতিদিন বারোটি শাস্ত্রে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। শিক্ষাগ্রহণকে তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ সাধনা হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। ফলে এর জন্য তার চেষ্টার কোনও অন্ত ছিল না। সর্বক্ষণ কিতাব নিয়েই পড়ে থাকতেন। খুব কম ঘুমাতেন। নিয়মিত দরসে হাজির হতেন। অধিত বিষয় লিপিবদ্ধ করতেন। পঠিত বিষয় বার বার পড়তেন। যা মুখস্থ করার দরকার হত তা মুখস্থ করতেন। গবেষণামূলক বিষয়ে পূর্ণ ধ্যানের সাথে চিন্তাভাবনা করতেন।
তার বুঝশক্তি ছিল অনেক গভীর। তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী ছিলেন। কোনও বিষয়ে ভাষাভাষা জ্ঞানে ক্ষান্ত হতেন না। তার গভীরে পৌছার চেষ্টা করতেন। এভাবে টানা ছয় বছর জ্ঞানসাধনায় লিপ্ত থাকেন। পরিশেষে তিনি ফিকহ, হাদীছ, 'ইলমুল উসূল, 'ইলমুল আরাবিয়্যাহ প্রভৃতি শাস্ত্রে বিপুল পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এসকল বিষয়ে তিনি যাদের নিকট থেকে বিশেষভাবে উপকৃত হন তাদের তালিকা অনেক দীর্ঘ। তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম নিচে উল্লেখ করা গেল।
১. আবু ইবরাহীম ইসহাক ইবনে আহমাদ আল-মাগরিবী রহ: ২. আব্দুর রহমান ইবনে আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে কুদামা আল-মাকদিসী রহ.; ৩. আবু মুহাম্মাদ 'আব্দুর রহমান ইবনে নূহ আল-মাকদিসী রহ.; ৪. আবু হাফস 'উমর ইবনে আস'আদ আল-ইরবিলী রহ., ৫. আবুল হাসান সাল্লার আল-হালাবী রহ., ৬. যিয়া ইবনে তাম্মাম আল-হানাফী রহ., ৭. আবু শামা আদ-দিমাশকী রহ., ৮. কাযী আবুল ফাতাহ 'উমর ইবনে বুনদার তাফলীসী রহ., ৯. কাযী 'ইমাদুদ্দীন হারাসতানী রহ., ১০. আবু যাকারিয়া হারানী সায়রাফী রহ.।
ইমাম নববী রহ. অতি উচ্চস্তরের মুত্তাকী-পরহেযগার ছিলেন। আগেই বলা হয়েছে, শৈশবকালেও তার খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ ছিল না। কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি মনোযোগী ছিলেন। যতই বড় হতে থাকেন, কুরআনের প্রতি 'ইশক ও আমলে সালিহার প্রতি আগ্রহও বাড়তে থাকে। ভোগ-বিলাসিতার প্রতি তার আকর্ষণ ছিল না। নির্মোহ জীবনযাপন করতেন। প্রকাশ্য ও গুপ্ত সর্বাবস্থায় অন্তরে আল্লাহভীতি লালন করতেন। অতি সাধারণ খাবার খেতেন ও সাধারণ পোশাক পরিধান করতেন।
তিনি হালাল খাবারের প্রতি খুব সচেতন থাকতেন। সন্দেহযুক্ত খাবার পরিহার করে চলতেন। এ কারণেই দিমাশকের কোনও ফল খেতেন না। এ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে বলেছিলেন, দিমাশকে ওয়াকফ ভূমি খুব বেশি। তাছাড়া এমন অনেক মালিকানাধীন জমিও আছে, যার উপর শরী'আতের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত আছে। এসব ভূমির ব্যবহারে মানুষ শরী'আতের সীমারেখা রক্ষায় যত্নবান থাকে না। সুতরাং এখানকার উৎপন্ন ফসল আমি নিশ্চিন্তমনে কিভাবে খাই?
অসাধারণ পাণ্ডিত্য, অতি উন্নত চরিত্র, নির্মোহ জীবন, নির্ভীক দা'ওয়াতী তৎপরতা প্রভৃতি গুণাবলীর কারণে মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল।
'আম-খাস নির্বিশেষে সকলেই তাকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখত। কিন্তু তিনি নিজে কখনও সম্মান ও সুখ্যাতির পেছনে পড়েননি। অর্থ-সম্পদ ও ক্ষমতার পেছনে ছোটেননি। বরং যে-কোনও সরকারি পদ থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতেন। সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা কখনওই গ্রহণ করেননি। 'ইলমে দীনের শিক্ষাদান, রচনা ও সংকলন, 'ইবাদত-বন্দেগী এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ- এ নিয়েই তিনি থাকতেন।
তিনি দিমাশকে সর্বমোট ২৮ বছর অবস্থান করেন। তারপর ৬৭৬ সালে জন্মভূমি নাওয়ায় ফিরে আসেন। ফেরার আগে ওয়াকফের যে সমস্ত কিতাব তার কাছে ছিল, সবগুলো ফেরত দান করেন। তারপর উস্তাযগণের কবর যিয়ারত করেন। জীবিত বন্ধু- বান্ধব ও ভক্ত-অনুরক্তদের সংগে দেখা করেন এবং তাদের কাছ থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে নেন। জন্মভূমিতে ফিরে আসার অল্পদিন পরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর আর বেশি দিন বেঁচে থাকেননি। এ বছরই রজব মাসের ২৪ তারিখ তার ইন্তিকাল হয়ে যায়।
তার রচিত গ্রন্থাবলী: 'ইলমে দীনের বিভিন্ন শাখায় তিনি বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। কয়েকখানি গ্রন্থের নাম এখানে উল্লেখ করা গেল।
১. আল-মিনহাজ- সহীহ মুসলিম শরীফের ভাষ্যগ্রন্থ। ইমাম নববী এ গ্রন্থ সম্পর্কে বলেন, আমার আশংকা রচনার কলেবর বেশি বড় হলে আমার শক্তিহ্রাস পাবে ও পাঠকসংখ্যা কমবে। তা না হলে এ গ্রন্থখানি আমি একশ' খণ্ডে সমাপ্ত করতাম।
২. আর-রাওযাহ।
৩. তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত।
৪. আল-মিনহাজ ফিল-ফিকহ।
৫. আল-আযকার।
৬. আল-মাজমূ'- শারহুল মুহাযযাব।
৭. বুস্তানুল 'আরিফীন।
৮. আল-ইরশাদ ফী 'উলূমিল হাদীছ।
৯. শারহু সুনানি আবী দাউদ।
১০. রিয়াযুস-সালিহীন।
তার রচিত গ্রন্থাবলী অত্যন্ত পাঠকপ্রিয়। শত শত বছর যাবত 'আম-খাস নির্বিশেষে সর্বস্তরের মুসলিম বিপুল সমাদরে তা পাঠ করে আসছে। কোনও কোনও গ্রন্থ এমনই উচ্চপর্যায়ের, যা এ যাবতকালের রচিত লক্ষ লক্ষ দীনী গ্রন্থাবলীর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম রচনার তালিকায় গণ্য হয়ে থাকে। সঙ্গত কারণেই মুসলিম গবেষক ও রচয়িতাদের মধ্যে তাঁর একটি বিশেষ মর্যাদার আসন রয়েছে। আমরা আশা করি কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর রচনাবলী তাঁর জন্য অতি মূল্যবান সদাকায়ে জারিয়া হয়ে থাকবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তা দ্বারা ভরপুর ফায়দা হাসিলের তাওফীক দান করুন- আমীন।
ইমাম নববী রহ.-এর ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। তিনি এক, মহা শক্তিশালী, প্রবল পরাক্রান্ত, মহা ক্ষমাশীল। তিনি হৃদয়বান ও চিন্তাশীল লোকদের উপদেশদান এবং জ্ঞানী ও শিক্ষাগ্রহণকারী লোকদের অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচনের জন্য রাত ও দিনের আবর্তন ঘটান। তিনি তাঁর সৃষ্টিকুলের মধ্যে যাকে চান সজাগ করেন। তিনি তাদেরকে ইহজগতের ব্যাপারে নির্মোহ করে তোলেন এবং তাদেরকে মশগুল করে দেন তাঁর ধ্যানে, সার্বক্ষণিক ফিকিরে এবং উপদেশ ও শিক্ষাগ্রহণে। তিনি তাদেরকে তাঁর আনুগত্যে অভ্যস্ত হওয়ার তাওফীক দান করেন এবং অনন্ত নিবাসের জান্নাতলাভের জন্য প্রস্তুতিগ্রহণে সাহায্য করেন। তিনি তাদেরকে সতর্ক রাখেন যাতে এমন কোনও কাজ না করে, যা তাঁর অসন্তুষ্টির কারণ হয় এবং তাদের জন্য ধ্বংসের নিবাস জাহান্নাম অবধারিত করে। সেইসংগে অবস্থা ও পরিবেশ- পরিস্থিতির আবর্তন-বিবর্তনে তাদেরকে সঠিক পথে অবিচল থাকারও তাওফীক দেন।
আমি তাঁর প্রশংসা করছি চূড়ান্ত প্রশংসা। আমি তাঁর প্রশংসা করছি বিশুদ্ধতম ও পরিপূর্ণ প্রশংসা। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই। তিনি পুণ্যময় ও মহানুভব। তিনি দয়ার্দ্য, পরমদয়ালু। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। তাঁর হাবীব ও খলীল। তিনি সরল সঠিক পথের দিশারী এবং সুপ্রতিষ্ঠিত দীনের আহ্বায়ক। আল্লাহর রহমত ও তাঁর শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর প্রতি ও সমস্ত নবীর প্রতি এবং প্রত্যেক নবীর পরিবারবর্গ ও সমস্ত নেককার বান্দার প্রতি। তারপর বক্তব্য এই যে, আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন-
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ (56) مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ (57)
'আমি জিন ও ইনসানকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার 'ইবাদত করবে। আমি তাদের কাছে রিযক চাই না এবং এটাও চাই না যে, তারা আমাকে খাবার দিক।" সূরা যারিয়াত, আয়াত ৫৬-৫৭
এর দ্বারা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তাদেরকে কেবল 'ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং যে উদ্দেশ্যে তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে, তাদের অবশ্যকর্তব্য তার প্রতি মনোযোগী হওয়া এবং নির্মোহ জীবনযাপনের মাধ্যমে দুনিয়ার ভোগবিলাস পরিহার করে চলা। কেননা এটা নশ্বর জগত। চিরদিন থাকার জায়গা নয়। এটা (পরকালীন গন্তব্যস্থলে) পৌঁছার বাহন, ফুর্তির জায়গা নয়। এবং এটা বিচ্ছিন্নতার ঘাঁটি, স্থায়ী ঠিকানা নয়। সুতরাং 'ইবাদতকারী বান্দাগণই এর সচেতন বাসিন্দা এবং নির্মোহ জীবন-যাপনকারীগণই এর সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান লোক। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
إِنَّمَا مَثَلُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الْأَرْضِ مِمَّا يَأْكُلُ النَّاسُ وَالْأَنْعَامُ حَتَّى إِذَا أَخَذَتِ الْأَرْضُ زُخْرُفَهَا وَازَّيَّنَتْ وَظَنَّ أَهْلُهَا أَنَّهُمْ قَادِرُونَ عَلَيْهَا أَتَاهَا أَمْرُنَا لَيْلًا أَوْ نَهَارًا فَجَعَلْنَاهَا حَصِيدًا كَأَنْ لَمْ تَغْنَ بِالْأَمْسِ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ (24)
'পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত তো কিছুটা এ রকম, যেমন আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করলাম, যদ্দরুন ভূমিজ সেইসব উদ্ভিদ নিবিড় ঘন হয়ে জন্মাল, যা মানুষ ও গবাদি পশু খেয়ে থাকে। অবশেষে ভূমি যখন নিজ শোভা ধারণ করে ও নয়নাভিরাম হয়ে ওঠে এবং তার মালিকগণ মনে করে এখন তা সম্পূর্ণরূপে তাদের আয়ত্তাধীন, তখন কোনও এক দিনে বা রাতে তাতে আমার নির্দেশ এসে পড়ে (এই মর্মে যে, তার উপর কোনও দুর্যোগ আপতিত হোক) এবং আমি তাকে কর্তিত ফসলের এমন শূন্য ভূমিতে পরিণত করি, যেন গতকাল তার অস্তিত্বই ছিল না। যে সকল লোক চিন্তা করে তাদের জন্য এভাবেই নিদর্শনাবলি সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করি।" সূরা ইউনুস, আয়াত ২৪
এ বিষয়ে বহু আয়াত আছে। জনৈক কবি বড় সুন্দর বলেছেন-
إِنَّ لِلَّهِ عِبَادًا فَطنَا + طلقوا الدُّنْيَا وَخَافُوا الْفِتَنَا
نظرُوا فِيهَا فَلَمَّا عَلِمُوا + أَنَّهَا لَيْسَتْ لِحَيِّ وَطنَا
جَعَلُوْهَا لُجَّةً وَاتَّخَذُوا + صالِحَ الْأَعْمَالِ فِيْهَا سُفْنَا
'আল্লাহর কিছু বান্দা আছে,
যারা ত্যাগ করেছে দুনিয়া, ভয় করেছে ফিতনার।
তারা দৃষ্টি দিল দুনিয়ার প্রতি। যখন জানতে পারল নয় এটা কোনও জীবিতের স্থায়ী ঠিকানা,
তখন একে গণ্য করেছে সাগর, আর করেছে অবলম্বন নেক আমলসমূহকে এ সাগর উতরানোর জাহাজরূপে।'
তো এই যে বললাম দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী আর আমাদেরকে এখানে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহ তা'আলার 'ইবাদত করার জন্য, তখন আমাদের কর্তব্য নেককারদের পথ অবলম্বন করা এবং বুদ্ধিমান ও জ্ঞানীজনদের পথে চলা। ইঙ্গিত করে এসেছি যে, প্রকৃত বুদ্ধিমানেরা দুনিয়ার প্রতি নির্মোহ থেকে 'ইবাদত-বন্দেগীতে মগ্ন থাকতেন। আমাদের কর্তব্য তাদের অনুরূপ কাজের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা ও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণের প্রতি যত্নবান হওয়া। এ ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ পন্থা ও সরল সঠিক তরীকা হল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত শিক্ষামালা ও আদব- কায়দা অবলম্বন করা। তিনি পূর্বাপর সমস্ত মানুষের নেতা। আগের ও পরের সকল মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান। তাঁর ও সমস্ত নবীর প্রতি বর্ষিত হোক আল্লাহর রহমত ও শান্তি।
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى
'তোমরা নেককাজ ও তাকওয়ায় একে অন্যকে সাহায্য কর।" সূরা মায়িদা, আয়াত ২
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশুদ্ধসূত্রে বর্ণিত আছে যে, তিনি ইরশাদ করেন-
وَاللَّهُ فِي عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِي عَوْنِ أَخِيهِ
'বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে লেগে থাকে, ততক্ষণ আল্লাহ তা'আলাও তার সাহায্য করতে থাকেন।' (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৯৯; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৯৪৬; জামে' তিরমিযী, হাদীছ নং ১৪২৫, ১৯৩০; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২২৫; আহমাদ, হাদীছ নং ৭৪২৭, ৭৯৪২, ১০৪৯৫, ১০৬৭৫)
তিনি আরও ইরশাদ করেন-
مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْر فَاعِلِهِ
'যে ব্যক্তি কোনও নেক কাজের পথ দেখায়, তার জন্য রয়েছে ওই নেক কাজের কর্তার অনুরূপ ছওয়াব।' (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৯৩; জামে' তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬৭১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৫১২৯: সুনানে ইব্ন মাজাহ, হাদীছ নং ২৪০; আহমাদ, হাদীছ নং ২২৩৫২)
তিনি আরও ইরশাদ করেন-
مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الْأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ، لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيْئًا .
'যে ব্যক্তি কোনও সৎকর্মের দিকে ডাকে, তার জন্য রয়েছে ওই সৎকর্মের অনুসরণকারীদের সমান ছওয়াব। তাতে তাদের ছওয়াব একটুও কমে না।' (মুআত্তা মালিক, হাদীছ নং ৪১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৭৪; জামে' তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬৭৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৪৬০৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২০৬; আহমাদ, হাদীছ নং ৯১৬০, ১৩৮০৪)
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত 'আলী রাযি.-কে উপদেশ দেন-
فوالله لأن يهدي الله بك رجلا خير لك من أن يكون لك حمر النعم
'আল্লাহর কসম। যদি আল্লাহ তা'আলা তোমার দ্বারা একজন লোককেও হিদায়াত দান করেন, তবে তা তোমার জন্য একপাল লাল উট অপেক্ষাও উত্তম।" (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৯৪২, ৩০০৯, ৩৭০১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৪০৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৩৬৬১; আহমাদ, হাদীছ নং ২২০৭৪, ২২৮২১)
(লাল উটের কথা বলা হয়েছে সেকালের দিকে লক্ষ করে। সেকালে এটাই ছিল সর্বাপেক্ষা দামী সম্পদ। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য- কারও হিদায়াতের জন্য মেহনত করা আল্লাহর কাছে দুনিয়ার সর্বাপেক্ষা দামী সম্পদ অপেক্ষাও মূল্যবান।)
সুতরাং আমি চিন্তা করলাম সহীহ হাদীছের একটি সংক্ষিপ্ত সংকলন তৈরি করব। তাতে এমনসব হাদীছ থাকবে, যা হবে এর পাঠকের জন্য আখিরাতের দিকে চলার পথস্বরূপ। পাঠক তা দ্বারা জাহেরী ও বাতেনী আদব-কায়দা শিখতে পারবে। তাতে প্রেরণাদায়ী ও সতর্ককারী- এ উভয়রকম হাদীছ থাকবে। এমনিভাবে তাতে থাকবে আল্লাহর পথের পথিকদের প্রয়োজনীয় যাবতীয় শিক্ষাসংক্রান্ত হাদীছ। যথা- যুহদ (দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তি) সম্পর্কিত হাদীছ, আত্মশুদ্ধি ও চরিত্র গঠনমূলক হাদীছ, কলবের পবিত্রতা ও আত্মিক রোগ নিরাময় সংক্রান্ত হাদীছ এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হেফাজত ও তার বক্রতা নিরসনমূলক হাদীছ। এমনিভাবে আল্লাহর মা'রিফাত ও তত্ত্বজ্ঞানসম্পন্ন লোকদের কাঙ্ক্ষিত অন্যান্য বিষয় সম্বলিত হাদীছসমূহও তাতে থাকবে।
এ সংকলনে আমার নীতি হবে কেবল সহীহ ও স্পষ্ট অর্থবোধক হাদীছসমূহই উল্লেখ করা। প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধ হাদীছ গ্রন্থসমূহের বরাতও উল্লেখ করে দেব। প্রতিটি অধ্যায় শুরু করব কুরআন মাজীদের আয়াত দ্বারা। কোনও শব্দের উচ্চারণ নিরূপণ করে দেওয়ার প্রয়োজন হলে তাও করে দেব। অস্পষ্ট অর্থেরও ব্যাখ্যা করে দেব। সেইসংগে উৎকৃষ্ট কোনও জ্ঞাতব্য বিষয় থাকলে তা উল্লেখ করব। কোনও হাদীছের শেষে যদি লিখি متفق عليه , তবে তার অর্থ এ হাদীছটি ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়ই উল্লেখ করেছেন।
যদি এ গ্রন্থখানি সংকলনের কাজ শেষ হতে পারে, তবে আমি আশা করি এটি মনোযোগী পাঠককে কল্যাণের পথে টেনে নেবে এবং তাকে সবরকম মন্দ ও ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বিরত রাখবে।
যে-কোনও ভাই এর দ্বারা কিছুমাত্র উপকৃত হবেন তার কাছে আমার নিবেদন- তিনি যেন আমার জন্য, আমার মা-বাবার জন্য, আমার উস্তাযগণের জন্য, আমার সকল বন্ধু-বান্ধবের জন্য এবং সমস্ত মুসলিম নর-নারীর জন্য দু'আ করেন।
মহান আল্লাহর প্রতি আমার ভরসা। তাঁর উপরই আমি নিজেকে ও আমার যাবতীয় বিষয় ন্যস্ত করি। আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কর্মবিধায়ক। পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময় আল্লাহ ছাড়া কারও কোনও ভালো কাজ করার শক্তি নেই এবং নেই কোনও মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকার ক্ষমতা।